রাজধানীর টঙ্গীর একটি কুরিয়ার সার্ভিস থেকে ইতালিতে পাচার হচ্ছিল ভয়ংকর মাদক কিটামিন। কিন্তু, ফ্লাইটে ওঠার আগেই টাওয়ালের মধ্যে বিশেষ কায়দায় লুকিয়ে রাখা সাড়ে ৬ কেজি ওজনের ওই মাদক জব্দ করেছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)।
এই ঘটনায় চাঁদপুর ও ফরিদপুর থেকে মাসুদুর রহমান জিলানী (২৮) ও আরিফুর রহমান খোকা (৪৩) নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা কুরিয়ারের মাধ্যমে কিটামিন পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছেন।
রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ডিএনসি সদরদপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সংস্থাটির মহাপরিচালক হাসান মারুফ।
তিনি বলেন, ডিএনসির গোয়েন্দা বিভাগ দীর্ঘদিন ধরে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদক পাচারের বিষয়টির ওপর গোয়েন্দা নজরদারি করে আসছে। এই গোয়েন্দা বিভাগের তৎপরতায় বিভিন্ন সময় বেশ কিছু চালানও জব্দ করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে, ডিএনসির কাছে গোপন তথ্য ছিল যে একটি চক্র আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করে দেশের বাইরে মাদক পাচার করছে।
এমন তথ্যে টঙ্গী ফেডেক্স কুরিয়ার সার্ভিসে অবস্থান নেয় ডিএনসির গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। পরে ফেডেক্সের সার্বিক সহযোগিতায় ঢাকা থেকে ইতালিগামী একটি পার্সেল জব্দ করা হয়।
গোয়েন্দা তথ্যের বরাতে ডিএনসি মহাপরিচালক বলেন, পার্সেলের সার্বিক অবস্থা ও অস্বাভাবিক ওজন দেখে সন্দেহ হলে পার্সেলটি পরীক্ষা করে একটি খাকি রঙের কার্টুনের ভেতর পৃথক সাতটি সাদা তোয়ালে পাওয়া যায়। পরে ঘটনাস্থলেই ডিএনসির পরীক্ষক দ্বারা তোয়ালের রাসায়নিক পরীক্ষা করে দ্রবীভূত অবস্থায় ৬.৪৪ কেজি ক শ্রেণির ভয়াবহ মাদক কিটামিন পাওয়া যায়।
পরবর্তীতে জব্দকৃত পার্সেলের প্রেরকের ঠিকানা, সিসিটিভি ফুটেজ ও অন্যান্য গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে আত্মগোপন করেছেন চোরাকারবারি গ্রুপের সদস্য মাসুদুর রহমান জিলানী। এর ভিত্তিতে ঢাকা গোয়েন্দা ইউনিট একটি অভিযান পরিচালনা করে চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর এলাকা থেকে জিলানীকে গ্রেপ্তার করে।
পরবর্তীতে আরও তথ্য পর্যালোচনা ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানা যায়, কিটামিনের চালানটি ফরিদপুর জেলার আরিফুর রহমান খোকার যোগসাজশে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। খোকা এই আন্তর্জাতিক চক্রের অন্যতম হোতা।
এরপর তথ্য প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ফরিদপুর জেলার সালথা থানার আটঘর বাজার এলাকায় আরও একটি অভিযান পরিচালনা করে আরিফুর রহমান খোকাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ডিএনসি মহাপরিচালক বলেন, কিটামিন মূলত একটি ডিসোসিয়েটিভ অ্যানেস্থেটিক ওষুধ, যা অতীতে চিকিৎসা ক্ষেত্রে অপারেশনের সময় অজ্ঞান করার জন্য ব্যবহৃত হতো। কিন্তু বর্তমানে ব্যাপকভাবে মাদক হিসেবে; বিশেষ করে পার্টি ড্রাগ হিসেবে এর অপব্যবহার হচ্ছে।
তিনি বলেন, কিটামিন একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর মাদক, যা স্বল্পমেয়াদে বিভ্রান্তি, হ্যালুসিনেশন ও শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি করে। দীর্ঘমেয়াদে এটি কিডনি ও মূত্রথলির গুরুতর ক্ষতিসহ মানসিক সমস্যার দিকে ঠেলে দেয়। নিয়মিত সেবনে জীবনের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করে এটি।
কিটামিন পাচারের কৌশল সম্পর্কে হাসান মারুফ বলেন, তোয়ালে বা মোটা কাপড় ব্যবহার করে মাদক পাচার একটি বিশেষ কৌশল; যেখানে তোয়ালের ভেতরে গঠন পরিবর্তন করে মাদক লুকানো হয়। কেমিক্যাল ইমপ্রেগনেশনে তোয়ালে মাদকের দ্রবণে ভিজিয়ে শুকানো হয়, ফলে মাদক ফাইবারে মিশে যায়। কাপড় বা তোয়ালেটি মাদক শোষণ করলে সেটি দেখতে স্বাভাবিক কাপড়ের মতোই মনে হয়, ফলে এটি সহজে শনাক্ত করা যায় না। পাচারকারীরা পরে বিশেষ কেমিক্যাল বা ল্যাব প্রসেস ব্যবহার করে ওই কাপড় থেকে পুনরায় মাদক উত্তোলন করে। এই পদ্ধতি কোকেন, হেরোইন ও কেটামিন পাচারে বেশি ব্যবহৃত হয়।
গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে আন্তর্জাতিক বাজারে এই মাদক পাচারের সঙ্গে আরও একাধিক ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ডিএনসি মহাপরিচালক হাসান মারুফ। তদন্ত সাপেক্ষে তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।